প্রকাশিত: ০১/০৫/২০১৮ ১০:৫৪ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৩:২৪ এএম

ঢাকাটাইমস

প্রতিদিন পাঁচ বাসায় কাজ করেন শিরীনা। প্রতিদিনই ভোরে তাকে বের হতে হয়। তিনি না গেলে রান্না হয় না।

ভোর সাতটায় বের হন তিনি। কাজ করে ঘরে ফিরতে ফিরতে বেলা একটা থেকে দেড়টা। এরপর বিকাল পাঁচটায় আবার কাজে বের হন, ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে নয়টা।

মাসের ৩০টি দিনেই তার কর্মদিবস। অন্যরা ছুটি কাটালেও তার কোনো ছুটি নেই। নিত্যদিন কাজ তার। ক্লান্তি নেই, বিশ্রাম নেই, নেই বিনোদন।

আর এত পরিশ্রম করে সংসার চালানোর মতো প্রাপ্য টাকাও জোটে না। সব মিলিয়ে মাসে পান ১১ হাজার টাকা। তার স্বামীও একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ভ্যান চালান।

দুই সন্তান থাকে বাড়িতে। তারা ঢাকায় এলে ভোর সাতটায় বের হওয়ার আগে রান্না করতে হয়। আর তারা না থাকলে?

শিরিনা বলেন, ‘দুই জন মানুষ, দুপুরে ঘরে ফিইরা কোনোমতে রান্না কইরা খাই দাই।’

এ রকম শিরীনাদের সংখ্যা হাজার হাজার। এদের কেউ ঘরে কাজ করেন কাজের চুক্তিতে, কেউ বা বাসায় ২৪ ঘণ্টা হিসেবে কাজ করেন।

যারা চুক্তিতে কাজ করেন, তারা রান্না বা ঘর মোছা, বা মাছ, তরকারি কাটাকুটি বা কাপড় কাঁচা বা অন্য কোনো কাজ করে মাসে চার শ থেকে সাত শ টাকা করে বেতন পান। তবে এই বেতন নির্দিষ্ট নয়। কোনো এলাকায় কম, কোনো এলাকায় বেশি। তবে সব জায়গাতেই সেটি যে নিতান্তই কম তা বলাই বাহুল্য।

নিত্য দিন কাজ করলেও শ্রম আইনে নেই শিরিনাদের নাম। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কিছু আইনি অধিকার রয়েছে। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য তার কিছুই নেই। এদের মধ্যে গৃহশ্রমিকদের অবস্থা আরও করুণ।

এই অবস্থাতেই শ্রমিকের অধিকারের দাবিতে ১ মে দিনভর নানা অনুষ্ঠান হয়েছে বিশ্বজুড়েই। বাংলাদেশেও স্লোগান উঠেছে অধিকারের দাবি। তাতে বঞ্চনাবোধ থেকে মুক্তি আর অধিকারের দাবিতে কত কথাই না হয়েছে। কিন্তু সেখানেও এই গ্রহশ্রমিকদের কথা উঠেনি বললেই চলে।

শ্রম আইনের বাইরে থেকে যাওয়া এই শ্রমিকরা কোনো ধরনের আইনি সুরক্ষা পায় না। আর তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার মানুষের সংখ্যাও নিতান্তই কম।

এই শ্রমিকের সংখ্যা কত, সে নিয়ে নেই কোনো পরিসংখ্যানও। তবে সংখ্যাটা অন্য যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের তুলনায় নেহায়েত কম না, সেটা সহজেই অনুমেয়।

ন্যূনতম কত বেতন হওয়া উচিত, বছরে কতদিন ছুটি পাওনা, আনুষঙ্গিক কী কী সুযোগ সুবিধা মিলবে, নিয়োগ বিধি কী হবে, চাকরি থেকে ছাটাইয়ের নীতিমালা কেমন হবে, তার কিছুই নির্দিষ্ট নয় অপ্রাতিষ্ঠানিক এই খাতের শ্রমিকদের জন্য।

অর্থাৎ শ্রমিকদের মধ্যেও প্রান্তিক গোষ্ঠী এই গৃহশ্রমিকরা। কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই, নেই ঐচ্ছিক বা অর্জিত ছুটি, অসুস্থতার ছুটি কী বিষয়, সেটি হয়ত ধারণাও নেই তাদের।

নেই সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা, কোন কাজের বেতন কত, নেই তার কোনো আইনি বিধি বিধান।

যিনি কাজ না করলে ঘরের অনেক কিছুই আটকে থাকত, ব্যাঘাত ঘটত রান্না বা ঘর গোছানোর কাজে, তার শ্রমের স্বীকৃতিটুকু পরিচয়েও জুটে না। সাধারণভাবে ‘কাজের বুয়া’, ‘কাজের মেয়ে’, ‘কাজের লোক’, ‘খালা’, ‘ঝি’ হিসেবেই পরিচয় তাদের।

নীতিমালার বাস্তবায়ন নেই

এই শ্রমিকদের জন্য একটি নীতিমালার খসড়ায় সরকার অনুমোদন দিয়েছে আড়াই বছর আগে। কিন্তু এরপর কী হয়েছে তা কেউ জানে না। ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ’ নীতিমালা করলেও সেটার প্রয়োগ নেই।

ওই নীতিমালায় গৃহকর্মীদের সবেতনে ১৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি, যৌন হয়রানি ও নির্যাতন, শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করলে সরকারকে মামলা পরিচালনার খরচ দেয়া, গৃহকর্মীদের সহায়তার জন্য ‘হেল্পলাইন’ চালুর কথা বলা আছে।

এ ছাড়া চাকরি ছাড়লে বা বিদায় করলে এক মাসের আগাম নোটিশ দেয়া, গৃহকর্মী নিয়োগের পর ছবিসহ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করা, শ্রমমন্ত্রণালয়ের তদারকি সেল গঠন, ন্যূনতম বয়স ১৪ আর অভিভাবকের অনুমতি মিললে ১২ বছর হওয়ার কথা।

তবে এই নীতিমালাতেও ন্যূনতম বেতন উপেক্ষিত। আবার যেসব সুযোগ সুবিধা বা আইনি সুরক্ষার কথা বলা হয়েছিল, সেটারও বাস্তবায়ন হয়নি এই সময়ে।

‘বাংলাদেশ ডোমেস্টিক ওয়ার্কার নেটওয়ার্ক’ নামে একটি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই গৃহশ্রমিকদেরকে নিয়ে কাজ করছে। এর প্রধান কাজী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সরকার যে নীতিমালা অনুমোদন করেছে, এর মধ্যে অনেক ফাঁক আছে৷ আমাদেরও দাবি ছিল বেতনের বিষয়টি নির্ধারণ করে দেয়া, কিন্তু তা হয়নি।’

‘আমরা বরাবরই গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের অধীনে আনার দাবি করে আসছি৷ সেটা করা হলে গৃহকর্মীরা শ্রম আইনের সুবিধা পেতেন৷ তাও করা হয়নি৷ ফলে গৃহকর্মীদের বেতনের বিষয়টি মালিকের মর্জির ওপরই রয়ে গেল।’

বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে বিলস। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই মে দিবসের মূল অর্জন বা চেতনা সেটি কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি।’

‘কোনো মতেই দেশের শ্রমজীবী মানুষকে বঞ্চিত রেখে, আইনের সুরক্ষা থেকে বাইরে রেখে তাদের মজুরির ব্যাপারটি ঠিকাদার ও মালিকদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়ে মে দিবস পালন করা যাবে না। দেশের উন্নয়নের যে দাবি করা হচ্ছে সেটি করাও যুক্তিসঙ্গত হবে না।’

 

পাঠকের মতামত

মিয়ানমারে সংঘাত/টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ঢুকল আরও ৯ বিজিপি সদস্য

মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ...